সোমবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৭

খোকার জন্য জব্দ

আমার খোকা তোমার কোলে আসবে বলে যখন
পেটের ভেতর এদিক-ওদিক হাত-পা ছুড়ে মারে
আমার তখন সারা শরীর শিকলমুড়ে বাঁধা
বন্দী আছি স্বৈরাচারীর অন্ধ কারাগারে।

দেশটা এখন জব্দ ভীষণ শোষক শ্রেণীর হাতে
খোকার জন্য এ দেশটাকে মুক্ত করতে হবেই
অরাজকতার দম্ভ ভাঙতে মৃত্যু যদিও আসে
জন্মদাতা হওয়া আমার সফল হবে তবেই।

তোমার মাথার সিঁথির সিঁদুর হয়তো যাবে মুছে
আমার চিতার অগ্নিশিখা জ্বলবে খাঁ খাঁ স্বরে
হয়তো হঠাৎ আমার খোকা শিখবে হামাগুড়ি
দন্তবিহীন তার হাসিতে শিউলি পড়বে ঝরে।

যেই কথাটি বলতে আমার কণ্ঠরুদ্ধ আজ
বজ্রকণ্ঠে আমার খোকা সেই কথাটি কবেই
স্বাধীনতার মুকুট আনতে শিকলবন্দী আমি
আমার খোকা স্বাধীন হতে অস্ত্র হাতে লবেই।

সোমবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৭

পা


আমি তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে
কাঁচ পেরুনো দৃষ্টি নিয়ে-ওর দিকে
চৌরাস্তার মোড়ে যেখানে প্রচন্ড যান্ত্রিক ভিড়।

জানালার শার্শিতে তখন একটা চড়ুই ডাকছিল
একা একা নাচছিল আর ডাকছিল
কারও প্রতীক্ষা বুঝি।
হঠাৎ আকাশচেড়া শব্দ-
নক্ষত্রকাঁপানো বিকট শব্দ
চড়ুই পাখিটা আচমকা কেঁপে উঠলো 
পাখা ঝাপটে চিৎপটাং কেঁপে উঠলো-
তারপর ভয়ার্ত উড়ে গেল ঐ দিকে
উঁচু দালানের আড়ালে, ঐ দিকে। 

আমি দেখলাম চৌরাস্তার ভিড়ে-
অজস্র মানুষের নিদারুণ ভিড়ে
দাউ দাউ জ্বলছে আগুন
আর বনপোড়া হরিণের মতো ছুটছে মানুষ 
শহরের সমগ্র মানুষ-
যেন সমুদ্র ঊর্মি অসম্ভব বেগে আন্দোলিত।

প্রচণ্ড সে বোমার বিস্ফোরণে 
ওর একটা পা ছিটকে এল-
উরু বরাবর থেতলে ছিটকে এল
দোতলার জানালার কার্ণিশে
আমার ঝুল বারান্দার জানালার কার্ণিশে।

ওহ, কী বীভৎস
টপটপে তাজা রক্ত কী বীভৎস-
জানালার কাঁচ বেয়ে ঝরছিল 
আমি আর কিছু বলতে পারি না। 

মুক্তির সুর বাজাবো সংঘাতে

সত্যের টুটি ধরেছে চেপে মিথ্যা আজ-
করো কী কাজ...! 
কাঁদে মজলুম মুক্তির লাগি। 
যারা জুলুমের দায়ে দায়ভাগী 
আজকে তাদের ঘৃণার কামানে দাগী। 

কানে দিয়ে হাত চাপা 
কতো কাল রবি ওরে- না শোনার ভান ধরে 
বৃথা অনুনয়ে হবে ব্যর্থ সময় মাপা। 

কুয়াশা কাটবে আজকে অথবা কাল 
কুৎসার জঞ্জাল 
ছিড়বো একদা নবীন প্রাতে। 
দিতে হয় প্রাণ দেবো শত্রুর হাতে 
মুক্তির সুর বাজাবো সংঘাতে। 

বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৭

আকিব শিকদার

আকিব শিকদার
কবি ও শিক্ষক
৮৪২/২ ফিসারি লিংক রোড
হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।
Email : akibshikder333@gmail.com
Mobile : ০১৯১৯৮৪৮৮৮৮
রচিত কাব্য গ্রন্থ ঃ কবির বিধ্বস্ত কঙ্কাল (২০১৪), দেশদ্রোহীর অগ্নিদগ্ধ মুখ (২০১৫) 
কৃষ্ণপক্ষে যে দেয় উষ্ণ চুম্বন (২০১৬)।

ভিনদেশে বিপর্যস্ত

মা আমাকে তার মাতৃসুলভ আচরণে
স্নেহের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে চাইতো, আমি দেইনি সম্মতি কখনো
তার বুড়ো আঙুলের নখটা কেমন মড়া ঝিনুকের
ফ্যাকসা খোলসের মতো ছিল বলে।
শৈশবে স্কুলে পৌঁছবার রাজপথে
যেদিন প্রথম দেখেছিলাম শিয়ালের থেতলানো দেহ
টানা তিনরাত ঘুমোতে পারিনি দুঃস্বপ্ন দেখার ভয়ে, পারিনি করতে 
আহার স্বাভাবিক। চোখের সামনে শুধু উঠতো ভেসে 
বিচ্ছিন্ন মস্তক একটা মরা শিয়াল যার উসকোখুসকো চামড়ায়
জমে আছে রক্তের স্তূপ আর তকতকে নীল মাছি।

খুব বেশি খুতখুতে
স্বভাব ছিল আমার। বাবা একবার আমার গামছা দিয়ে 
মুছে ছিলেন তার শস্যক্ষেত থেকে ফিরে আসা ঘর্মাক্ত পিঠ,
সেই অপরাধে তার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার
করে দিয়েছিলাম মূর্খের অপবাদ দিয়ে। এক বিছানায় ঘুমোতে গিয়ে 
আমার যে ছোটভাইটা গায়ের উপর তুলে দিতো পা
আমি এক চড়ে তার কান থেকে রক্ত ঝরিয়ে বুঝিয়েছিলাম 
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে যাওয়ার খেসারত। 

এখন আমার ঘুম আসে না, ঘুম আসে না রাতে
ছাড়পোকা আর মশাদের উৎপাতে। উৎকট গন্ধে
বন্ধ দম, শৌচাগারের পাশে বিছানায় নেই গা ঢাকা দেবার মতো 
টুকরো কাপড়। শীতে জুবুথুবু হয়ে যখন কুকড়ে যাই
তোকে বড়ো মনে পড়ে, তোকে বড়ো মনে পড়ে ভাইরে। ঘুমঘোরে একটি পা
গায়ের উপরে তুলে দিবি না আমায়
একটু আরাম উত্তাপ? বল, তুই করবি না
ক্ষমা আমায়...?

ওরা যখন আমাকে নিয়ে এসেছিল ভিনদেশে
বলেছিল কাজ দেবে পাঁচতারা হোটেলে, নিদেনপক্ষে মুদির দোকান তো
জুটবেই কপালে। সূর্য ওঠার আগে
শাবল ক্ষন্তা আঁকশি হাতে লেগে যাই কাজে, নগরের নর্দমা
শোধন এখন আমার কাজ। 
যে হাতে ধরিনি গরুর দড়ি গোবর চনার গন্ধ লাগবে বলে
সে হাত ধরে পঁচা ইদুরের লেজ, পলিথিনে মোড়া 
মাছি ভনভন করা মাছের পুরনো আঁশ। পরিত্যক্ত আবর্জনা 
তুলে নিই পিঠের ঝুলিতে। বড়ো অসহায়, বড়ো অসহায় লাগে মা,
মনে হয় মরে যাই; না গেলে কাজে নিতান্ত বুভূক্ষু
কাটে দিন, পানিটাও এইদেশে কিনে খেতে হয়, টাকা ছাড়া জোটে না
কান চুলকানোর কাঠিটি পর্যন্ত। 

একবার, শুধু একবার, মা তোমার গোবর গুলে গৈঠা বানানো হাতে
একমুঠো ভাত খাইয়ে দিয়ে যাও। 
বাবা, ও বাবা, আমার গায়ের সবচেয়ে সুন্দর যে জামাটি
তাতে মোছো তোমার ভাত খেয়ে না ধোয়া হাত। তোমার সফেদ দাড়ির ভাজে
তরকারির যে ঝোল লেগে থাকে
সেই ময়লাটি জিহ্বায় চেটে তুলে নিতে বড়ো ইচ্ছা জাগে আমার। 

আষাঢ়ের বৃষ্টিধারা

দেখি জানালার পাশে বসে তিনতলা ঘরে
নিচে রাস্তায় আষাঢ়ের বৃষ্টিধারা ঝরঝর ঝরে
পথ প্রায় জনহীন, দু-একজন ছাতা হাতে যায় হেঁটে হেঁটে
চৌচাকা গাড়ি কাচের জানালা আঁটা, ছুটছে দ্রুত পানি কেটে কেটে
একটা কুকুর বেওয়ারিশÑ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সাওয়ার
গাছের পাতায় জল, বেড়ে গেছে গতি দুষ্ট হাওয়ার।

একটানা ভিজে ভিজে কালো পিচপথ হলো আরো কালো
আকাশের ধূসর মেঘ ক্রমে ক্রমে হয়েছে ঘোরালো
একজোড়া ছেলেমেয়ে কাছাকাছি স্কুল শেষে ফিরছিল বাড়ি
মনে ওদের লেগেছে রং বুঝিÑ আভাস পাই যে তারই
মেয়েটার নীল ফ্রক সাদা পায়জামা, হাতে হলুদ ছাতা
কাঁধে লাল ব্যাগ বইয়ে বইয়ে পূর্ণÑ চুলে বাঁধা ফিতা
ছেলেটির সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পায়ে সাদা পাম-সু
কালো ব্যাগে বই কাঁধে ফিটফাট চেহারা, ভাবেসাবে ‘হামসু’।

হঠাৎ দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল ছাতাটা মেয়েটার হাত হতে
পড়লো ছিটকে গিয়ে হাঁটুজল বেঁধে যাওয়া গলির পথে
ছুটে গিয়ে ছেলে আনলো কুড়িয়ে ছাতা, তুলে দিলো মেয়েটার হাতে
সযতনে রাখলো ভাঁজ করে লাল ব্যাগে বই পেনসিলের সাথে
বেপরোয়া বৃষ্টিতে হাঁটলো তারা হাতে হাত ধরে
চলাচলে ছন্দ, নৃত্যের ভঙ্গিতে হাঁটছে বুঝি গান করে করে
ভেজা কাক ওড়ে আকাশে, ওড়ে ঘন ছাই মেঘ আষাঢ়ি
পাশাপাশি ছেলে আর মেয়ে, ঢাকলো ওদের ধূসর বৃষ্টির মশারি।

কদম

ঋতুটি শরৎ এখন পঞ্জিকার পাতায়।
বর্ষার আমেজ কাটেনি বুঝি, সারাটি আকাশ 
কালো করে নামে বৃষ্টি।
একটানা ভিজে শালবন, মহুয়ার কিশলয়। সতেজ হয়--
লতানো পুঁইয়ের ডগা। 

এ বর্ষণ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই। দূর পরবাসে 
বসে আমি ভাবি--আহ, কি সহজেই ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম
প্রিয় ফুল কদমের কথা... ! 
পড়ার টেবিলে দুটো কদম, আষাঢ় শ্রাবণে তরতাজা দুটো কদম
জিইয়ে রেখেছি কতো--
কাচের বোতলে। ভেজা বাতাসে কদমের হালকা সুবাস।
তিনটে বছর, মাত্র তিনটে বছর 
ভুলিয়ে দিলো চব্বিশ বছরের বর্ষার স্মৃতি, যেন চব্বিশ বছর
পরাজিত তিন বছরের পাল্লায়।

পরিজন ফোন করে খবর নিতে--'কি পাঠাবো বল...?
কাঠালের বিচি ভাজা, চিনে বাদাম, ঝুনা নারকেল
নাকি আমের আচার... ?'--ওদের তালিকায় 
আমার পছন্দ অনুপস্থিত।

সাহেবদের বিলেতি ফুলের ভিড়ে 
ঠাঁই নেই কদমের--
যেমন আছে কাদা মাটির সোঁদাগন্ধ ভরা বাংলায়।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখি 
ফুটফুটে কদমের শ্বেত রেণু বিনিময়, আর অন্তরে অনুভবে
রূপ-রস-গন্ধ।

মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৭

বালক বালিকা

আসমানী শাড়ি নিখুঁত পড়ে আছে আলনায়
পড়ে আছে রেশমি চুড়ি, সাদা কাঁচুলী, শিউলির মালা, বেলিফুল
অবহেলায় কাচ-পোকা টিপ, হীড়েকুচি নোলক, ঝিনুক কানের দুল।
       বালিকা সাজঘরে আয়নায়
                প্রতীক্ষা গুনে কী এক অস্থিরতায়
বালক এলেই সাজবে মোহিনী সাজ; রুপার নূপুর দেবে পায়-
বালকের আগমন যেন তার একমাত্র উৎসব।
এসেছিল বালক, কড়াও নেড়েছিল খুব
‘কেন এতো দেরি হলো’- বড়ো বেশি অভিমানে বালিকা খোলেনি দ্বার
বালকের হাতে ছিল কৃষ্ণচূড়া, আলতা আর সুগন্ধি আতরসম্ভার
         বালিকার কপালে কপাল-
ছুঁয়ে সৃখবৃষ্টিতে ভেজার কথা আজ, আস্ত বিকাল।
     তবু দ্বার খোলেনি বালিকা
শোনেনি বালকের হৃদয়জ আহাজারি। অর্ঘ হাতে ভীষণ একা
দরজায় ক্রমাগত ঠকঠক
চিরপরিচিত করিডোরে অনঢ় দাড়িয়ে রয় নাছোড়বান্দা বালক-
          যেন তার একমাত্র পূজনীয়া দেবীটি বালিকা।