রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭

ব্যর্থ ডুবুরী

চেয়েছিলাম একটি বেগুনী ফুল, তুমি এনে দিলে ঝুলবারান্দায়
ঝুলিয়ে রাখার মতো দুটো অর্কিড-চারা নারকেলের খয়েরী মালায়।
সকাল বিকাল আমি জল ঢালি খুব যতনে- আর তুমি
অফিসে যাবার আগে একবার পাতায় পাতায়
বুলিয়ে যাও হাত, ফিরে এসে আরবার ধরো। যেন পিতা
তার চঞ্চল কন্যার ববকাট চুলে স্নেহের আঙুল চালায়।
যেদিন ফুটলো প্রথম ফুল তুমিই খুশি
হলে সবচেয়ে বেশি।
আমাকে একেবারে কোলবালিশের মতো আড়কোলে তোলে
কপালে খেলে খপাৎ খপাৎ চুমু, আর বার বার তাকালে
হালকা হাওয়ায় কাঁপা প্রজাপতির পাখার মতো
ছিটছিট অর্কিড পাপড়িগুলোর দিকে।
আমি তো জানি কতো যে ভালো তুমি বাসো আমায়। তাই আমার
একাকীত্ব কাটিয়ে দিতে দিলে উপহার
খরগোশ একজোড়া, একটি ধবধবে সাদা
অন্যটি সাদায় কালোয় মিশ্রিত
যাদের লালন করি আমি আপন শিশুর মতো
গালে গাল মিশিয়ে- যেন আমিই তাদের মা। মুখে তুলে দেই কতো
চাকচাক করে কাটা গাজরের ফালি, বাধাকপির কচি সবুজ পাতা।
আমার কোন আবদার রাখেনি অপূর্ণ তুমি। আমিই কেবল পারিনি...
মনে কি পড়ে... চেয়েছিলাম
পদ্মার ইলিশ-সর্ষে ভাজি? তুমি আমাকেই নিয়ে গেলে পদ্মায়
জোয়ারের বেলা জেলেদের নৌকায়
উঠে নিজের হাতে ধরলে ইলিশ। যে ইলিশ ভেজেছি
পহেলা বৈশাখে উত্তপ্ত উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে আর আঁচলে মুছেছি
গলার ভাঁজে জমা রূপালি মালার মতো ঘাম। তখন তুমি
কোমর জড়িয়ে ধরে কামড়ে দিলে কান, আর হাতের আঙুলে
এক চিমটি সর্ষে ইলিশ মুখে নিয়ে বললে-
‘বড়ো মধুর হয়েছে আমার
রাধুনীর রান্না।’-মনে কি পড়ে? মনে কি পড়ে?
অথচ আমি বারোটি বছর ধরে
তোমাকে প্রতিদান কিছু দেবো বলে কতো যে চাই- যেমন একটি সন্তান,
তবু পারি না দিতে। হাজার হাজার মাইল সাঁতরে এসে আমি যেন
অতলান্তিক সমুদ্রপুরী থেকে শূন্য হাতে উঠে আসা ব্যর্থ ডুবুরী কোন।
তুমি যখন আমাকে খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসো...
ব্যর্থতার গ্লানী আর অপারগ অপরাধের ভার
বুকে নিয়ে গলায় কলস বেধে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে আমার।

ত্রিদীপ

এক.
বুকের ভেতর প্রজ্জ্বলিত বারুদের ক্ষোভ, আগুন যদি না জ্বলে
তবে নিজেকে পুড়িয়ে যোগাবো আলো।
জীবনকে ঢেলে সাজাবার ডাক দিয়ে যাই-
‘পথ নাই আর পথ নাই
অন্ধকারে অগ্নীশিখা জ্বেলে দূর করতেই হবে কালো।’
দুই.
দুর্ভিক্ষের আঁচড় লেগেছে যাদের গায়, তারা কি তবে
নিঃসম্বল হয়েই মরবে সবে....?
ক্ষুধার্তের বোবা কান্না আর বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস শুনেও
ত্রিদীপ হাতে ক্রুদ্ধ দেবতা দেবালয়ে নিরব দাঁড়িয়ে রবে...!!
তিন.
জালিমের দল ছাউনী গেড়েছে আমাদের অঙ্গনে
প্রদীপের মতো উপকারী আলো বিলাবার দিন আর নয়...
বারুদোত্তাপে জ্বলে উঠবার এসেছে কঠিন সময়।

খোকার জন্য জব্দ

আমার খোকা তোমার কোলে আসবে বলে যখন
পেটের ভেতর এদিক-ওদিক হাত-পা ছুড়ে মারে
আমার তখন সারা শরীর শিকলমুড়ে বাঁধা
বন্দী আছি স্বৈরাচারীর অন্ধ কারাগারে।
দেশটা এখন জব্দ ভীষণ শোষক শ্রেণীর হাতে
খোকার জন্য এ দেশটাকে মুক্ত করতে হবেই
অরাজকতার দম্ভ ভাঙতে মৃত্যু যদিও আসে
জন্মদাতা হওয়া আমার সফল হবে তবেই।
তোমার মাথার সিঁথির সিঁদুর হয়তো যাবে মুছে
আমার চিতার অগ্নিশিখা জ্বলবে খাঁ খাঁ স্বরে
হয়তো হঠাৎ আমার খোকা শিখবে হামাগুড়ি
দন্তবিহীন তার হাসিতে শিউলি পড়বে ঝরে।
যেই কথাটি বলতে আমার কণ্ঠরুদ্ধ আজ
বজ্রকণ্ঠে আমার খোকা সেই কথাটি কবেই
স্বাধীনতার মুকুট আনতে শিকলবন্দী আমি
আমার খোকা স্বাধীন হতে অস্ত্র হাতে লবেই।

সময়টা ঘর বাঁধবার

সময়টা ঘর বাঁধবার। খুব বেশি শীত নেই এখন
এমন কি খুব বেশি গরমও না। এখনো বৃষ্টি ঝরে না তেমন-
তাই পথে নেই কাদা, হাটুজল।
শুষ্কতাও এতো বেশি যায়নি বেড়ে-
দিকে দিকে ধুলো আর ধুলো উড়বে কেবল।
সময়টা ঘর বাঁধবার। ফাগুনের হাওয়া লেগে কাঁপছে ভূবন
ডালে ডালে পাখি আর বনে বনে জন্তুরা
সঙ্গী খুঁজতে ব্যাকুল এখন।
গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন মিস্তিরি, কখন যে কার ঘর বাঁধবার
পড়ে প্রয়োজন...!
ইট-কাঠ-লোহা আসছে দেদার। যাতায়াতে বাধা নেই
নেই অসহ্য দূর্গমতা পথের-
গলিতে গলিতে ঘুরছেন ঘটক সাহেব, উপযুক্ত
কপোত-কপোতী পেলে বেঁধে দেবেন জোড়। নতুন সম্বন্ধ মানেই
নতুন একটি ঘর।
ঘটক কি তবে মিস্তিরি...? নাকি দুজনেই ঘর বাঁধবার কারিগর...!
শোনা যায় ঘোষণাধ্বনি, বাতাসের বুক চিড়ে
কারও মৃত্যু সংবাদ শুনিয়ে যাচ্ছে মাইক। একটি নতুন করে
ঘর বাঁধতে হবে। নতুন একটি কবর মানে নতুন একটি ঘর।
আজরাইল কি তবে ঘটক, নাকি মিস্তিরি...? নাকি ওরা সকলেই
ঘর বাঁধবার কারিগর..!

যুদ্ধ ফেরত

যুদ্ধ কোন ছেলে খেলা নয়-
এ বিষয় ছেলেটার ভালো করে জানা। ওর টগবগে রক্তের
প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সর্বক্ষণ
লেগে আছে দাউ দাউ সংগ্রামী অগ্নি।
বুনো বেবুনের মতো ডালে ডালে নেচে বেড়ানো
চটপটে, দাঁত খিচিমিচি করে হাসা ছেলেটা-
নিশানা ওর যথেষ্ট তীক্ষ্ণ, নির্ভুল; প্রতিজ্ঞা ওর মৃত্যুর মতো
অমোঘ, অপরিবর্তনীয়। কেননা তার শৈশব কেটেছে
মারবেল আর ডাঙ্গুলী খেলে।
মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাঠি ছুঁড়ে আমপাড়া ছেলেটা
তাই বুঝি পেরেছিলো-
অজস্র পাহারাদারের দৃষ্টিতে ছানি ফেলে চুপিচুপি ছিনিয়ে নিতে
হানাদারদের কার্তুজ, আর কী নিপুণ লিচু চুরি করা হাতে
তুলে নিতে ঠসঠসে আতার মতো মারাত্মক গ্রেনেডগুলো।
ছেলেটা দেখেছে বহুবার
তার মাকে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখা রত্মগর্ভা মাকে-
পিক ফেলতে গিয়ে শনের বেড়ায় আঙুলের চুন মুছতে।
মায়ের সে আঙুলের ছাপ, চুন মাখা টিপসই
আজও তার চোখে ভাসে বর্ণখচিত ব্যানারের মতো, যেন সেই
শনের বেড়াটি বিপ্লবের প্রতিবাদী পোস্টার।
যুদ্ধ সে যতোই স্থায়ী হোক, আর রক্তক্ষয়ী, ঘাতকের মুখে
চুনকালি মেখে থুথু ছিটিয়ে
বন্দুকের নলে পত পত বাংলার পতাকা দুলিয়ে, বনে ফেরা
বাঘের মতো ঘরে ফিরবেই ছেলেটা। ঘরে ফিরবেই ছেলেটা
সেই বোনটির জন্য- যে বোন বিছানায় হুমড়ি খেয়ে কান্না ছাড়া
কিছু আর পারে না, সেই মায়ের জন্য
ঘরে ফিরবেই ছেলেটা- যে মা জানালায় পথ চেয়ে বসে আছে
সন্তানের, আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই
অতর্কিতে যে বাবাকে তুলে নিলো হানাদার বাহিনীর জীপ
তার জন্য তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য
সমগ্র বাংলাদেশটা তাবিজ সম গলায় ঝুলিয়ে
কেশর ফোলানো সিংহের মতো ঘরে ফিরবেই ছেলেটা।

ভাঙনের ঝড়

আসমানের নীলে কিছু মেঘ ঘোরে একা
কিছু বৃষ্টি ঝরে অশ্রু হয়ে অঙ্গনে
জানালা খুলে দেখি আলোটা বিবর্ণ
বাতাস খেলা করে কাননের ফুলে নিজমনে।
সবুজ পাতারা গুচ্ছবদ্ধ তবু নীরব অসহায়
আঁধারটা মনে হয় অনন্ত অসীমের সীমানায়।
স্মৃতির রোমন্থনে রাত ফুরায় বিছানায় নির্ঘুম
কষ্টগুলো ফেরারি বাদুড়ের মতো নিশাচর
কিছু বাসনা রয়ে যায় অপূর্ণ আজীবন
নিঃস্বহায় দিনগুলো অসহ্য অবিনশ্বর।
তবে কি ভাঙনের ঝড় এ জীবনে দিয়েছিল হানা
তা না হলে এত কিছু কেমনে হলো জানা!!

বিপ্রতীপ

খাঁচার পাখি সুখ খুঁজতে পালিয়ে গেলো বনে
মুক্ত বনে খাঁচার কথাই পড়ছে কেনো মনে!!
ঘরের বধূ ঘর ভেঙেছে শান্তি খুঁজতে শান্তি
শান্তি তো নেই, স্বামীর স্মৃতি বাড়িয়ে দিলো ক্লান্তি।
হারিয়ে গেলেই বুঝতে পারি- যা ছিলো তাই ভালো
যা ছিলো না খুঁজতে তাকে গিয়েই তো হারালো।

কোনোদিন আর ভুল হবে না

কোনোদিন আর ভুল হবে না, আপনি বলতে ঠোঁটের ডগায় আর
তুমি বলা এসে যাবে না।
এই কান ধরে বলছি গো, মাথা ছুঁয়ে বলছি- আপনার পথের পানে
আর চেয়ে থাকা হবে না।
আর কোনোদিন আমি তাকাবো না আড়চোখে, আপনি যতই পরে আসুন
নতুন শাড়ি। কপালের টিপ যদি ভুল করে অস্থানে হয়ে যায়
ইশারায় আর আমি দেখাবো না...
আপনি বলতে ঠোঁটের ডগায় আর
তুমি বলা এসে যাবে না; কোনোদিন আর ভুল হবে না।
আপনি যদি আমাকে রেখেই চলে যান চুপিচুপি, চলে যান
কবিতা পাঠের আসর ছেড়ে। এই মাটি খেয়ে বলছি গো, কিড়া কেটে বলছি-
আর রাগ করে আমি মুখ ফোলাব না...
আপনি বলতে ঠোঁটের ডগায় আর
তুমি বলা এসে যাবে না; কোনোদিন আর ভুল হবে না।
আমি তো কারো টাকাতে কেনা গোলাম নই, নিজেকে দেইনি বেচে
অন্যের হাতে। কেন আপনারে ভেবে বৃথা হই উচাটন- এই মন
আর কারো মনোমত চলবে না...
আপনি বলতে ঠোঁটের ডগায় আর
তুমি বলা এসে যাবে না; কোনোদিন আর ভুল হবে না।

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

অফিসে যাবার বেলায় আমি আর বাবা

হাতে পায়ে লোশন মালিশকালে পড়লো মনে
বাবা তো এ বস্তু মাখেনি কখনো গায়ে...!
নাকে মুখে ছাকা ছাকা সরিষার তেল মেখে বলতেন-
‘খাঁটি জিনিস, বড়ো উপকারী, চোখে ধরলে আরও ভালো’
সে যুগের মানুষ ছিলেন কি না
এ যুগের কি বুঝবেন...! অথচ লোশন
তখনো দোকানে পাওয়া যেতো ঠিকই।

জেল মাখা চুলগুলো পরিপাটি আঁচড়াতে গিয়ে দেখি
আগেকার আয়নাটা ছিলো না তো এতো বড়
আর এতো মসৃণ...! ছিলো একফালি ভাঙা কাঁচ, তাতেও আবার
প্রতিবিম্ব বিকৃত। বাবার মাথায়
শুষ্ক চুল, চিরুণীর দাঁত কটা বিলীন, নতুন যোগানোর
নেই আয়োজন- টানাপোড়নে এমনি সাদামাটা বেঁচে থাকা।

রিক্সাতে উঠে যাই অনায়াসে, শুধাই না ভাড়া
বাবা ঠিকই চড়তেন দাম দড় কষে, যেন যাত্রা শেষে
ধূর্ত চালক না পারে খসাতে
একটি টাকাও বেশি। কিংবা রাজ্যের পথ
পায়ে হেঁটেই দিতেন পাড়ি, তবু
পকেটের টাকা পকেটেই থেকে যাক- এই যেন পণ।

সেন্টের ঘ্রাণমাখা জামা, সিগারেট ফুকে ফুকে চলি
পথের ভিখারি যেই চায় দুটো পয়সা হাত বাড়িয়ে
অমনি দিলাম রাম ধমক, অকথ্য গালাজ তো আছেই।
বাবা তাকে ফেরাতেন খালি হাতে
তবু ধমকটা দিতেন না; আর তার কাছে সিগারেট ফুকা মানে
অকাতরে অর্থ ওড়ানো। অল্প আয়ের লোক-
বাউন্ডুলে তোড়জোড় তাকে কি মানায়...?

অফিসে ঢুকেই দেখি বেশুমার মক্কেল প্রতীক্ষা গুণে,
চেয়ার টেনে বসতেই টেবিলের আবডালে চলে আসে টাকা।
ঘুষ বললে মন্দ শোনায়, বাঁ হাতের কারসাজি
ডাকি আমি এ-কে।
এমন সুপটুতা ছিলো দুষ্কর বাবার পক্ষে
অতি ভীতু ব্যক্তির দ্বারা হবে কেন
এ তো নির্ভীক সওদা...!
হয়তো তিনি বলতেন- ‘এ কাজ করার আগে
মরণ দিও প্রভু, তবু ঘুষ নয়।’
বাবাটার লাগি বড়ো মায়া হয়, জীবনটা তার
কোনদিন উপভোগ করা হলো না। সে যুগের মানুষ ছিলেন কি না
এ যুগের কি বুঝবেন...!