বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

একরাত অভিমান


কমলারঙের শাড়ি ছিলো পরনে, আঁচলটা কাধ বেয়ে
কোমড়ের কাছে এনে বাঁধা। কেমন একটা জাদরেল ভাব মুখটায় আঁকা
চলার গতিতে স্পষ্ট তাড়াহুড়ো, নির্বাক অধর। কোথাও যাবার
আয়োজনে ব্যস্ত নিশিতা।
পুটলা পুটলী তৈরি, বড়সড় স্যুটকেস শুধু তার নিজস্ব
কাপড় চোপড়, কসমেটিকÑকয়েকটা নৈমিত্তিক টুকিটাকিতে পূর্ণ।

তার স্বামী নুহাশ, দরজার পাশটায় টেবিল যে ছিল এক ঘুণ ধরা
তার উপর বসে। চোখ জলে ছলছল, মুখে হাসি টানা
বউ এর প্রস্তুতি দেখে- আড়চোখে নিরীক্ষণ। যেন এই চলে যাওয়াতে
তার নেই কোন ভ্রোক্ষেপ। স্বামী-স্ত্রীতে সামান্য বিবাদ, কথা কাটাকাটি
তাই এই বিদায়ের আয়োজন এসেছে ঘনিয়ে।

তিন বছরের সংসার, ছেলেমেয়ে নেই-
পিছুটান মুক্ত। এতোবড়ো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটুও লাগেনি সময়।
নিশিতা বাপের বাড়িতে নেবে ঠাঁই, স্বামী যাক জাহান্নামে।

বাইরে বিকেল, মেঘগুলো সোনালি আবির মাখা। আকাশের চিলগুলো
একটাও নেই আকাশে।
বেরিয়ে যাবে নিশিতা, নুহাশের মৌনতা- ইজি চেয়ারে বসে
গালে হাত ঠেসা, জানালার ফাঁক দিয়ে উদাসীন দৃষ্টি দিগন্তের খোলামাঠে।

ছিলো একগোছা চাবি
নিশিতার আচলে বাধা। চাবি গোছা রাখতে গিয়ে ওয়ারড্রবের ছাদে
চোখে তার পড়লো একটা ছবি কাঁচ দিয়ে মোড়ানো
বিয়ের প্রথম বছর সেই যে গিয়েছিলো হানিমুনে, সেখানেই তোলা।
নুহাশ আর নিশিতা
একত্রে ঠেস দিয়ে বসা গাছের শেকড়ে, হাতে হাত ধরা।
মনে তার পড়লো কিছু স্মৃতি ভাসা ভাসা- বিদায়ের বেলা
ছবিটার পাশে দাঁড়িয়েই।

নুহাশের চাইছিল মন বলবে নিশিতাকেÑ‘অন্তত
আজ রাতটা থেকে যাও’ -তবু বলা হলো না।
চরম অভিমান, বউ এর কাছে যাবে হেরে
এমনটা হয় কেমনে...!
যাবার বেলায় নিশিতার মনে বারবার খেলা করে
একটা বিষয়। একবার, শুধু একবার বলতো যদি নুহাশ
‘যেয়ো না গো’- রাগে কিংবা অভিমানে, তবু যাত্রা এখানেই হতো ভঙ্গ।
দেখলো নিশিতা পিছু ফিরে ফিরে- নাবোধক ইশারা... তাও পেল না বেচারী
স্বামীর কাছ থেকে, তাই চলে গেল ভারী স্যুটকেস পিছু পিছু টেনে।

সন্ধ্যার খানিক বাদে গেলো সে পৌঁছে
বাবা মার বাসায়। নিশিতার অনাকাক্সিক্ষত আগমনে
পিতা মাতা শঙ্কিত- ‘কিরে...
নুহাশকে দেখছি না যে, রাগ করে এলি বুঝি?’ নিশিতা দিলো না
জবার কোন- শুধু রইলো মুখ গোমরা করে।

রাতে খাবার টেবিলে বারবার
গিরো গেলো এটে নিশিতার গলায়, খাওয়া হলো না। মনে পড়ে
নুহাশের স্মৃতি- কেন এই অভিমান।
এদিকে নুহাশ কেমনে করবে আহার নিশিতাকে ফেলে- এ কথা ভেবে
ছাদে করলো বিচরণ একাকি অন্ধকারে, খিদে গেল মিটে হাওয়া চিবিয়ে।

বিছানায় শুয়ে ঘুম এলো না চোখের পাতায়- পাশের বালিশ
খালি পড়ে আছে, স্ত্রী নেই ঘরে।
কী একটা বেদনা যেন কুঁকড়ে ধরলো নুহাশকে সহসা
ডিমলাইটের সবুজাভ অল্প আলোতে। সদ্য জবাই করা মোরগের মতো
ছটফট করে বারবার রাখলো হাত
খালি বিছানায়- নিশিতা যেখানে ঘুমায় নিরবে।
এদিকে নিশিতা ঘুমায়নি কোন রাত স্বামীকে জড়িয়ে না ধরে বুকে-
পতির সোহাগ তার ঘুমের মহা ঔষধ। এপাশ ওপাশ
করলো সে বই এর পাতা যেমন
উলটে বাতাসে, আঘাত প্রাপ্ত কেচুর মতো শ্বাসরুদ্ধ অস্তির।

মধ্যরাতে নুহাশ বসে টেলিফোন স্যাটটার সামনে
কয়েকটা চাপ বাটনে- নিশিতাদের বাসার নাম্বার। রিং দিতে গিয়ে
রেখেদিলো টেলিফোন কি জানি কি ভেবে। বউ এর কাছে যাবে হেরে
এমনটা হয় কেমনে...!
‘একটা কল ও তো দিলো না নুহাশ’- ভাবে নিশিতা
ক্ষণে ক্ষণে ল্যাম্পলাইট জ্বালিয়ে নিভিয়ে। মোবাইল মনিটরে নাম্বার টুকে
কল তবু দিলো না- এতো রাতে নুহাসকে ডিস্টার্ব
হবে না উচিৎ। দুজনার রাত গেল কেটে অসহ্য অনিদ্রায়।

খুব প্রভাতে সেজেগুজে
প্রস্তুত নিশিতা। মা বললো ডেকে- ‘নাস্তাটা খেয়ে যা, রাতে ভালো খাসনি।’
কে শুনে কার কথা, যেন নুহাশকেই বেশি প্রয়োজন
নাস্তার চেয়ে। এমন সময় কলিং বেলটা সুর করে
উঠলো বেজে, দরজা খুলতেই মাথানত নুহাশ ঢুকলো ঘরে।
‘এ কি বাবা তুমি, এতো প্রভাতে...!’ -বিস্মিত শ্বশুর মশাই, বিড়বিড় করে
বললো নুহাশ- ‘বউ এর কাছে হেরে যাওয়া, এ তো আর পরাজয় নয়।’