বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭

অন্ধগুহার ক্ষ্যাপাটে

এদেশ আমার চামচিকার গন্ধবিদগ্ধ
  অন্ধগুহা, গলিতে গলিতে যার
নিঃসহায় মানুষজন শুকনো জিভ বের করা কান্ত জন্তু।
যুদ্ধার্জিত স্বাধীন নাগরিকেরা যে দেশের
অশ্বমেধের ঘোড়া, চোখ কানামাছি করা কলুর বলদ, থাকবেই-
দেখেও না দেখার ভান ধরে।

বালির উপর গড়ায় কারও রক্ত, যার মানবিক মূল্য
পায় যদি সে গাড়ির চাকায় ছিচকানো নোংড়া জলের সমান-
ধন্য জীবন। দুশ্চিন্তা রেখা কপালে সবার
ফুটে আছে ফুটিফাটা চোত-বোশেখি জমির মতন, ক্রন্ধনজয়মন্ত্র
ভুলে গেছে বাসিন্দারা সেই কবে।
তবু কেউ কেউ এরই মাঝে
এমনি চাটুকার, গায় শুনা গান প্রভুদের শেখানো সুরে, আর হাসে-
নিঃসীম তুষামুদি অট্টহাসি।
এসব দেখেই ক্ষ্যাপাটে আমি
তুলি অস্ত্র নিজেরই বুকের দিকে। স্বেচ্ছায় করি লন্ডভন্ড
আদিগন্ত রেললাইন ভীষণ ক্রোধে, ভাঙি নিজেরই হাতে গড়া
সীমান্ত নিজের।

এদেশ আমার চামচিকার গন্ধ বিদগ্ধ
অন্ধগুহা, আর এর বাসিন্দারা! কি বলবো, সহজ কথায়
ঘৃণা করতেও ঘেন্না লাগে। ঢের ভালো
এর থেকে আঙিনায় ভাঙা উনুনের পাশে ছায়ের গাদায়
লেজ গুটিয়ে চক্ষুবুজা একলা কুকুর।

প্রভাতের প্রথম পাখি

হুলো বিড়াল তিনবার শুঁকলো গন্ধ
পুরনো দেয়ালের, তারপর লেজ উঁচু করে দিলো ছিটিয়ে
মূত্র কয়েক ফোটা। থাম্বার পাদদেশে চট বিছিয়ে
বসেছেন যে ল্যাংড়া ভিখারি তার হাতের লাঠি
বড়োবেশি দেখালো ভয় বিড়ালটিকে
বাতাসে দুপাক ঘুরে।

‘ছাই নেবে গো ছাই’- যিনি করছেন চিৎকার গলা ফাটিয়ে
তিনি আর কেউ নন, বস্তিপাড়ার সেবিনা বেগম, যার বড় মেয়ে
তিন বেলা মেজে দেয় এঁটো থালাবাটি
এর তার ঘরে, যার ছোট ছেলে
পিঠে ঝুলি নিয়ে কুড়ায় কাগজ, পুরনো বোতল, ভাঙ্গা-ছেড়া
প্লাস্টিক আর আস্তাকুড়ের ঝিম ধরে পড়ে থাকা নেড়িকুত্তাকে
ঢিল ছুড়ে মজা পায়।
‘ছাই নেবে গো ছাই’- যার প্রাণের স্বামী রাজমিস্তিরি ছিলো
ছাদ থেকে পরে গিয়ে মরে গেছে দুবছর হলো। কি সহজেই
চলে যায় সময় আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে যাওয়া বালির মতো,
চাইলেই ধরে রাখা যায় না তাকে।

রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান
ক্যাটলির নলে রেশমী ধোঁয়ার নাচ, ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে
গেল পত্রিকার গাড়ি। কাকেরাই হয়তোবা প্রভাতের প্রথম পাখি
যারা ডেকে ওঠে অট্টালিকার সবচেয়ে উঁচু খুঁটিটায় বসে
আর উড়ে যায় এ-ছাদ ও-ছাদ, কৃষ্ণপালকে
সূর্যকিরণ মেখে।

বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭

রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা

ভালবাসার জন্য মানুষ কী না পারে-
কী  না পারে বলুন?
সাত সাগর তেরো  নদী পার!
হোহ... সে তো
সামান্য, ফুলের রেণুর মতো যৎসামান্য।

হানাদার বাহিনীর হাতে
ধরা পড়েছিল একজন
সোনার মানুষ, মুক্তিকামি সোনার মানুষ।
শত অত্যাচার, তবু
মুখ খুললো না সাহসী সে তরুণ।
যদিও বেয়নেটের খোঁচা
লাগছিল উরুতে, বুকে স্টেনগান ধরা
মুখের উপর কটু প্রশ্ন-
‘আমাদের জিজ্ঞাসার
জবাব চাই, অগত্যা গুলি করে মারবো তোমায়।’
চূড়ান্ত নির্ভীক বলে, বুকভরা
খাসা দেশপ্রীতি ছিল বলে-
নিচু হয়ে চুমু খেল
স্বদেশের মাটিকে, প্রেয়সীর গালে শেষ চুম্বনের মতো।
তারপর উঠে দাঁড়ালে
সটান, ঝাকড়া চুলের বাবরি নাড়িয়ে বল্লে-
‘যথেষ্ট প্রস্তুত আছি, আমার রক্ত
প্রিয় দেশটাকে দেবে স্বাধীনতা’।

বাতাসের কলরব
থামলো হঠাৎ। ছিঁড়ে গেল মালার আদলে ওড়া
পাখিদের ঝাঁক; ভিজে গেল ঘাস, শ্যামল মাটি।
ভেজা পতাকার মতো
রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা, আর
নক্ষত্ররূপী জ্বলজ্বলে জামার বোতাম।

অপারগ সাংবাদিকের ক্যামেরা

ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিন-
অর্থাৎ এক কথায় ছবি তুলতে করছি নিষেধ
আপনাকে, সাংবাদিক সাহেব। গলায় ঝোলানো এই ছবি তোলার যন্ত্রটা
এর উপর আপনি আস্থা রাখুন কী করে এতো, কী আছে এর ততো
শক্তি, অথবা কারিশমা
প্রকাশ অযোগ্যকে ফুটিয়ে তোলার!
বড়জোর আমার হাতের
তরতাজা রাইফেল, প্রাণঘাতি ঝকমকে কার্তুজ, মাথায় গামছা বাঁধাই
বাবরি চুল, বটের বীজের মতো জ্বলজ্বলে বিনিদ্র চোখ, বিজয়োন্মুখ মুখ
আর হাস্যোজ্জ্বল ফুল্যঠোঁটের ঝলমলে ছবি তুলে নেওয়া ছাড়া?

ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিন- অর্থাৎ এক কথায়
ছবি তুলতে করছি নিষেধ আপনাকে, সাংবাদিক সাহেব।
পৃথিবীর কোনো কলামিস্ট কোনো যুগে
পেরেছে কি টুকে নিতে ক্ষমতামাতাল বর্বর প্রভূর
বজ্রকঠিন চোখ রাঙানোকে অগ্রাহ্য করে যে বিদ্রোহী ছিঁড়ে দু’হাতের শৃঙ্খল
অথবা দাসত্বের দলিল তার আপাতালাকাশ আক্রোশ পেরেছে কি
টুকে নিতে সংবাদপত্রের সজীব পাতায়?
কলম যতই বলধর হোক, কোনো কবি
কোনো কালে পেরেছে কি লিখে নিতে
বেপরোয়া লড়াকু যোদ্ধার নাছোড়বান্দা আদর্শ, মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়েও
পিছু না হাঁটার অঙ্গীকার, শোষক রাজার নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে অসহযোগ
পেরেছে কি লিখে নিতে তার নিজস্ব খাতায়?
আর ঝানু চিত্রকর আকাশের মতো প্রশস্থ ক্যানভাসে
এঁকে দিতে বিক্ষুব্দ দেশপ্রেমিকের হৃদপি-
যে স্পন্দনে কাঁপে
সেই ঝনঝন ঝনাৎকার সম কম্পন রেখা পেরেছে কি
এঁকে দিতে রং তুলির খোঁচায়?
ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিন- অর্থাৎ এক কথায় ছবি তুলতে
করছি নিষেধ আপনাকে, সাংবাদিক সাহেব।

আপনার ক্যামেরার এপার্চার, আকাশচুম্বী জুমিং কৌশল
অত্যাধুনিক অভ্রভেদী ল্যান্স, পারবে না তুলে ধরতে আমার বুকের
লোকানো বিপ্লব, মুখের হাসির আড়ালের ক্রোধ, বাহুর পেশির সঞ্চিত শক্তি
পারবে না তুলে ধরতে ডিমকুসুম রক্তিম নয়নের
নেপথ্য তথ্য, আর মুষ্ঠিবদ্ধ আঙুলের বেষ্টনিতে যে ঝটিকাতুল্য চঞ্চলতা
নিয়ম না মানা উল্লাসে নাচে তার স্বতন্ত্র মুদ্রা। জানি....
আপনার ছবি তোলার যন্ত্রটা কারিশমা যতই দেখাক না কেন
বড়ো অপারগ আমার বুকের পাঁজরে
প্রতিশোধের যে উন্মত্ত দামামা বাজে
তার সুর, মগজের ভাঁজে
বিমূঢ় আস্ফালন নয়, যে দুর্দমনীয় বজ্রের কানাকানি
তার ভয়ংকর বহিঃপ্রকাশে বড়ো অপারগ। তাই...
ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিন- অর্থাৎ এক কথায়
ছবি তুলতে করছি নিষেধ আপনাকে, সাংবাদিক সাহেব।

প্রহরীরা প্রহরে প্রহরে

সবুজ ঘাসের বুকে তামাটে তাবু, কাঁটা তারের বেড়া
সীমান্ত এলাকা এটি। ঝরে আছে কিছু
মর্মরে মরা পাতা
পাহাড়ি চাম্বলের, শৈবাল ঢাকা পাথুরে ধূসর ঢিবিতে।

এখানে যাদের গেরস্থালী
পায়ে ওদের চামড়ার ভারী বুট, হাতে দূরবীন, কোমরাবদ্ধে
ধাতব পানির বোতল।
ওরা ডুয়োপিঁপড়ের আদর্শে কর্মঠ। ওরা মৌমাছির মতো
সুশৃংখল দলবদ্ধ, ভিম্রোপোকার মতো হিংস্র আক্রমণাত্মক।
সাথে যে কুকুরটা ওদের
এলসেসিয়ান প্রজাতির, ভীষণ সিয়ানা (দাঁতগুলো
নেক্রের কাছ থেকে ধার করা, খক খক চিৎকার যেন
হিজরা বাঘের হুংকার) তেপান্তরের প্রান্তরে
তার কান রাখে খাড়া
দুবৃত্তের সতর্ক আগমনী শুনবে বলে, নাক রাখে তৎপর
নিতে শত্রুর ঘ্রাণ। আকাশে ওদের
পোষমানা সোনালি ঈগল প্রহরীর দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে চক্রাকারে-
প্রহরে প্রহরে দেয়
প্রতিকী সংকেত কর্কশ স্বরে এবং তড়িৎ ছোঁ।

আমার যে ভাই ছ’মাস বয়সী সন্তানের মুখে দুগ্ধ যোগাতে
কাঁটাতার টপকাতে চায়
ওরা তার লাশ ফেলে রাখে ঝোপের আড়ালে
দুমড়ানো কদলীবৃক্ষের মতো। আমার যে বোন বৃদ্ধ বাবার
হাঁপানী রোগের ডাক্তারি খরচ মেটাতে শর্তবদ্ধ পাচারকারীর খপ্পরে
ওরা তার মরদেহ ঝুলিয়ে রাখে
তারের বেড়ায় জানালা উগলে ছোঁড়া উচ্ছ্বিষ্ট যেমন।
শান্তির সফেদ পায়রা ওড়াতে গিয়ে সন্ধি-সীমান্তে
কখনো-সখনো ওড়ায় ওরা
নখারো শকুন, স্নিগ্ধ পতাকার বদলে রক্তাপ্লুত ওড়নি।